প্রায় ২৮ ঘণ্টা পর টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস ফ্যাক্টরির ভয়াবহ
অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অগ্নিকাণ্ডে ফ্যাক্টরিটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত
হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে আরো লাশ চাপা পড়ে আছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর গতকাল
বিকালে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আরো চারটি লাশ
উদ্ধার করা হয়।
শনিবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান রিপন দাস (৩২) নামে এক শ্রমিক।
এ নিয়ে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ২৯ জন নিহত হলেন। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়বে
বলে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা জানিয়েছেন। এখনো ১০ জন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন।
গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের
হচ্ছিল। আগুনের ধোঁয়া, রাসায়নিক উপাদান ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে ফায়ার
সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা কারখানার অভ্যন্তরে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় প্রবেশ
করে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। গাজীপুরে সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহনের ১০টি
গাড়ি সেখানে মজুদ করা হয়েছে। এ ছাড়া বুলডোজার ও র্যাকার দিয়ে ধ্বংসস্তূপ
থেকে কংক্রিট সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে লাশের দুর্গন্ধ
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বিসিকের প্রধান সড়কে ভেঙে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্য
থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ওই রাস্তায় ভবনের নীচে পথচারীরা চাপা পড়ে থাকতে
পারেন বলে স্থানীয়রা ধারণা করছেন।
এখনো নিখোঁজ ১০ জন
নিখোঁজদের স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার পাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। জেলা
প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিখোঁজ ১০ জনের নাম তালিকাভূক্ত হয়েছে। এরা
হলেন-মাগুরা সদরের চনপুর ইডারন গ্রামের আব্দুল মালেক মোল্লার ছেলে আজিম
উদ্দিন (৩৬), টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার উকুলকি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে
জহিরুল ইসলাম (৩৭), গাজীপুর মহানগরীর হিমারদিঘী আমতলী বস্তি হরিজন কলোনির
দিলীপ ডোমের ছেলে রাজেশ বাবু (২২), লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানার শিবপুর
গ্রামের মোঃ আবু তাহেরের ছেলে রিয়াদ হোসেন মুরাদ (৩২), সিরাজগঞ্জের
শাহজাদপুর থানার ঝিগারবাড়িয়া গ্রামের মমতাজ আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেন (৪৫),
একই এলাকার সুলতান গাজীর ছেলে আনিছুর রহমান (৩০), কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর
থানার মেছেরা গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪০), চাঁদপুরের কচুয়া
থানার তেগুরিয়া গ্রামের ইউনুস পাটোয়ারীর ছেলে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (৪৫),
কুমিল্লার মুরাদনগর থানার টনকী গ্রামের তোফায়েল হোসেনের ছেলে মাসুম আহমেদ
(৩০) ও ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার বাহির নগর গ্রামের মোজাম মোল্লার
ছেলে চুন্নু মোল্লা (২২)।
নিখোঁজ সবাই ফ্যাক্টরির শ্রমিক-
কর্মচারী। কন্ট্রোলরুমের পাশে নিখোঁজ স্বজনরা তাদের প্রিয়জনের খোঁজ নিতে
এসে ছবি হাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা তাদের প্রিয় স্বজনের সন্ধান চান। এই
১০ জনের পাশাপাশি নিখোঁজের তালিকা বাড়তে পারে।
২৮ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে
আগুন ২৮ ঘণ্টা পর রবিবার সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো
কারখানার ভবনের ভগ্নাংশের নীচতলা, চারতলা ও চারতলার ছাদের ওপর নির্মাণ করা
কয়েকটি ঘর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি দিয়ে
ধোঁয়া নির্বাপণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চারতলা ভবনের ফ্যাক্টরির
চারদিক ধসে গেলেও মাঝখানের অংশ দাঁড়িয়ে আছে। এটি যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে
বলে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় ডিডি মো. মোজাম্মেল হক জানান। ফায়ার
সার্ভিসের উপ-পরিচালক জহিরুল আমিন মিয়া রবিবার সকালে জানান, আগুন
নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুরোপুরি নিভে গেলে ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল মোশারফ হোসেন বলেন, আগুন পুরোপুরি
নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে। ভবনের ভাঙা অংশের
কারণে পানি সব স্থানে পৌঁছানো যাচ্ছে না। যেখানে পুনরায় আগুন বা ধোঁয়া উঠছে
সেখানেই আমরা পানি দিচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করছে। ১০টি
পাম্পের সাহায্যে সার্বক্ষণিক পানি ছিটানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি পুকুর
শুকিয়ে গেছে। আরেকটি পুকুরে পাম্প বসানো হয়েছে। কারখানার ৩টি ভবনই একসঙ্গে
ধসে পড়ায় এবং সর্বত্রই কেমিক্যালের ছড়াছড়ির কারণে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে
আনতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আশপাশের ভবনগুলোকে রক্ষা করতে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছি। যে কোনো মুহূর্তে ভবন দেবে যেতে পারে বা কেমিক্যালের কারণে আরো
বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ফলে আমরা সাবধানে পদক্ষেপ নিচ্ছি।
ধ্বংসস্তূপ থেকে চার লাশ উদ্ধার
রবিবার সন্ধ্যা পৌনে ৬ টায় ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আরো চারজনের মরদেহ
উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম
ইত্তেফাককে বলেন, বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ধ্বংসস্তূপ সরানো শুরু করেন ফায়ার
সার্ভিসের কর্মীরা। এরপর পৌনে ৬টার দিকে চারটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের
পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তারা পথচারী নাকি শ্রমিক তাও নিশ্চিত হওয়া
যায়নি। লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
২৫ লাশ হস্তান্তর
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে ২৫টি মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে
হস্তান্তর করা হয়েছে। যাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে, তারা হলেন- আনিসুর
রহমান, আব্দুল হান্নান, ইদ্রিস আলী, জাহাঙ্গীর আলম, মামুন, রোজিনা, মিজান,
সাইদুর রহমান, মাইনুদ্দিন, আল মামুন, হাসান সিদ্দিকি, সোলেমান, এনামুল হক,
রাশেদ, শঙ্কর সরকার, গোপাল দাস, রফিকুল ইসলাম, সুভাষ চন্দ্র প্রসাদ, আশিক,
দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন, তাহমিনা আক্তার, জুয়েল
ও রিপন দাস। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মধ্যে ৯ জন
চিকিত্সাধীন রয়েছেন।
দায়ীরা শাস্তি পাবে : শিল্পমন্ত্রী
শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু রবিবার সকালে কারখানা পরিদর্শন করেছেন। এসময়
তিনি বলেন, ঘটনায় যাদেরই গাফিলতি থাকবে তারা যে প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার
হোকনা কেন শাস্তি পাবেই। মন্ত্রী বলেন, আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে
ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছি, সমস্ত শিল্পনগরীর কারখানায় এধরনের কোনো লিকেজ আছে
কিনা তা খতিয়ে দেখা হোক। বয়লার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা, মেয়াদ
উত্তীর্ণ কোনো বয়লার চালু আছে কিনা– থাকলে সেগুলো বন্ধ করতে ব্যবস্থা করার
জন্য বলা হয়েছে। পরিদর্শনকালে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, শিল্প
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
সঠিক তদন্ত চাই : ড. কামাল
বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় সঠিক তদন্ত চেয়েছেন গণফোরামের
সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, একজন শ্রমিক বলেছেন যে, বয়লার বিস্ফোরণ
হয়েছে আবার বয়লার ইন্সপেক্টর বলেছেন, গ্যাস পাইপের লিকেজ থেকে অগ্নিকাণ্ড ও
হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যারা তদন্ত করছে আমি মনে করি
যারা আহত ও বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে তথ্য নিতে হবে। এজন্য মিল মালিকের
বক্তব্য নিতে হবে, যারা বয়লার ইন্সপেক্টর তাদের বক্তব্য নিতে হবে, যারা
কাছে থেকে দেখেছেন তাদের (শ্রমিকদের) বক্তব্য নিতে হবে। এ ব্যাপারে
আন্তর্জাতিক আইনও রয়েছে, আইএলও’র আইনেরও আমরা সহযোগিতা নেব। এসময় তার সঙ্গে
বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর
রহমান ইসমাইল, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের এসিস্টেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি
মো. গোলাম কাদের, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের
সভপতি শামীমা নাসরীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শনে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) নেতৃবৃন্দ
রবিবার সকালে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুস
সালাম, গাজীপুর মহানগর সভাপতি আব্দুস সাত্তার মিয়া, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল
আবেদীন আর্মিসহ নেতৃবৃন্দ কারখানার বিধ্বস্ত ভবনটি পরিদর্শন করেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন